গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ‘মহাত্মা’ উপাধি পেয়েছিলেন লালন সাঁই

 


সুরাইয়া নাজনীন: সাধক পুরুষ লালন সাঁইয়ের জন্ম ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর। আবার ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর-ই বিখ্যাত এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লালন সাঁইয়ের মৃত্যু হয়। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক ছিলেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামে পরিচিত। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার গান উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন।

 তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।

 তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর যুদ্ধ করে গিয়েছেন। তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কুষ্টিয়া তখন জেলা ছিল না, অবিভক্ত ভারতবর্ষে নদীয়া জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল।

 লালন গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন। প্রথম দিকে লালন ছেউড়িয়া গ্রামের কালীগাঙের পাড়ে গহীন বনের মধ্যে একটি আম গাছের নীচে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ধ্যান মগ্ন লালন কখনও জঙ্গল থেকে বের হতেন না। তিনি জঙ্গলের মধ্যেই আনমেল নামের এক প্রকার কচু খেয়ে থাকতেন।

 লালন সাঁই গানের মাধ্যমে সমাজের জাতিভেদ, উচু-নীচু, ধর্মীয় গোঁড়ামী, স্যুঁৎ প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে মানুষের বিবেককে জাগিয়েছেন । মানুষের ভিতরের পশুকে হত্যা করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। লালনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিলো না, তার ছিলো বিবেকের শিক্ষা।

পৃথিবীতে সব সাধক পন্ডিৎ ব্যক্তিরা এসেছেন মানুষের কল্যানে, সমাজের কল্যানে। তারা কখনো নিজেদের নিয়ে ভাবেন নি। তারা  মানুষের মুক্তির পথ খুঁজেছেন, দেখিয়েছেন আলোর পথ। লালনের গান দেহকেন্দ্রীক। গ্রামের মানুষেরা এই গানকে দেহতত্ব বলে থাকে। লালন বিশ্বাস করতেন এই মানব দেহের মধ্যেই সব আছে। এই দেহের মধ্যেই ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি বাস করে। লালন মানবদেহকে কখনও ‘ঘর’ কখনও ‘খাঁচা’ আবার কখনও ‘আরশীনগর’ নামে ডেকেছেন।

 ১৮৯০ শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাউল সম্রাট মরমী সাধক মারা যান। যেদিন ভোরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ঐ দিনও সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url