লালন সাঁই কেন আমাদের ‘মনের মানুষ’

 


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ


আমি বরাবরই লালনগীতির ভক্ত ছিলাম। কোথাও এই গান শুনলেই উতলা হয়ে উঠতাম। হাটে-বাজারে যেখানেই শুনতাম; দাঁড়িয়ে যেতাম। মনে মনে প্রায়ই গাইতাম, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে-যায়?’ কিন্তু তখনো জানতাম না, এই লালনগীতির স্রষ্টা কে? ধীরে ধীরে বিভিন্ন বই পড়ে জানতে পারি, লালন এক আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি একাধারে ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।


যাকে ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও চিনতে শুরু করি। কলেজের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে ভর্তি হয়ে চোখ অনেকটাই খুলে যায়। সবচেয়ে বেশি জানতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষের বানানো ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি দেখে। এ পর্যন্ত আমি চারবার দেখেছি সিনেমাটি। দেখার পরামর্শ দিয়েছি অনেককে। যতবারই দেখি, আমার অন্তর্চক্ষু খুলে যায়। অন্য এক মানুষকে আবিষ্কার করি। খুঁজে ফিরি আমার মনের মানুষকে।


ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবিটি ২০১০ সালে মুক্তি পায়। এতে দুই দেশের বিভিন্ন শিল্পী অভিনয় করেন। সিনেমায় লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের কিছু চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে জমিদারী করতে এসে দেখা পান লালনের। জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর পদ্মা নদীর বজরায় বসে লালনের একটি স্কেচ তৈরি করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হলেন শহুরে বুদ্ধিজীবী, তিনি লালনের সাথে বাউলের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার মাধ্যমেই লালনের জীবন চলচ্চিত্রের দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়।


যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তবে লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসূত্র তার রচিত ২৮৮টি গান। কিন্তু লালনের কোনো গানে তার জীবন সম্পর্কে তথ্য রেখে যাননি। কয়েকটি গানে নিজেকে ‘লালন ফকির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই আমরা তাকে সন্ধান করেই যাবো।


লালন ফকিরের জন্ম কোথায়, তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কেননা লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।’


 সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url